টেলিমেডিসিন এমন এক চিকিৎসাব্যবস্থা, যার জন্য ডাক্তারের সামনে রোগীর উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ টেলিমেডিসিন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাজী সাইফুদ্দিন বেন্নুর-এর সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন ডা. সাকলায়েন রাসেল
আপনি বসে আছেন বাংলাদেশের কোনো এক হাসপাতালে। সুদূর আমেরিকায় বসে একজন সার্জন আপনার অপারেশন করছেন। এটা কিভাবে সম্ভব? এমন অসম্ভব বিষয়কে সম্ভব করা হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে শাখাটির মাধ্যমে তার নাম টেলিমেডিসিন। এককথায় বলতে গেলে ডাক্তারের সামনে রোগীর সরাসরি উপস্থিতি ছাড়াই ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে যখন রোগীর সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে তা-ই টেলিমেডিসিন। চিকিৎসা সম্পর্কিত নানা তথ্য আদান-প্রদানের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি হলো টেলিমেডিসিন।
কিভাবে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়
এ ক্ষেত্রে ভিডিও প্রযুক্তির সাহায্যে সবচেয়ে কার্যকর উপায়ে টেলিমেডিসিন চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। গ্রামেগঞ্জে বসে একজন রোগী স্থানীয় ডাক্তারের সহায়তায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শহরের কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন এমনকি পরীক্ষাও করতে পারেন। রোগীর হার্টের গতি, ইসিজি, পালস অক্সিমিটার ইত্যাদি এখন হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও একজন ডাক্তার অবলোকন করতে পারেন। এভাবে গ্রামে থেকে শহরে, এক শহর থেকে আরেক শহরে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে অতি অল্প খরচে, অল্প সময়ে চিকিৎসাসেবা নেওয়া সম্ভব। এমনকি রোবট ব্যবহার করে মহাকাশযানে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার অপারেশন সম্পন্ন করা সম্ভব টেলিমেডিসিন প্রযুক্তির মাধ্যমে।
বাংলাদেশেও টেলিমেডিসিন সার্ভিস
বাংলাদেশে অনেক আগেই টেলিমেডিসিন সার্ভিস চালু হলেও তেমন ব্যাপকতা লাভ করেনি। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এমনকি ভুটানও এ ক্ষেত্রে এগিয়েছে অনেকদূর। ভারত ২০০১ সাল থেকেই বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের প্রায় সমমর্যাদা অর্জন করেছে টেলিমেডিসিন সেবায়। আমাদের দেশ বিগত কয়েক বছরে টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরে বেশ এগিয়েছে। তাই টেলিমেডিসিন সেবা এ দ্রুত প্রসার লাভ করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
সম্পদের অসম বণ্টন আমাদের দেশের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ৭০ শতাংশ লোক গ্রামে বাস করে। কিন্তু প্রায় ৭৫ ভাগ চিকিৎসক শহর অঞ্চলে বসবাস করেন। রাস্তাঘাট এখনো অনুন্নত। এ দেশে টেলিমেডিসিন সেবা চালু হলে দেশের সব মানুষকে সর্বাধুনিক চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা সম্ভব হবে।
টেলিমেডিসিনের সুবিধা
- যারা দেশের বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন তারা টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে দেশে বসেই আপনার ডাক্তারের সঙ্গে চিকিৎসা পরবর্তী চেক-আপ করাতে পারছেন। এতে প্রচুর সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয়।
- শহরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবা দ্রুত গ্রামেগঞ্জে পৌঁছানো সম্ভব।
- দেশের অনেক জায়গায় রাস্তাঘাট এখনো অনুন্নত। এসব জায়গার লোকজন ঘরের কাছেই টেলিমেডিসিন সেবা নিতে পারবেন।
দুঃখের বিষয় এতসব সম্ভাবনার পরও দেশে টেলিমেডিসিন বিষয়টি অবহেলিত, এ ব্যাপারে এখনো কোনো সরকারি পলিসি তৈরি হয়নি। যে দু-একজন উদ্যোগী হয়েছিলেন রাজনৈতিক তালগোলে তাঁরাও হোঁচট খাচ্ছেন
কিছু সীমাবদ্ধতা
- রোগীরা মানসিকভাবে খুব বেশি তৃপ্ত হয় না
- গ্রামের মানুষ বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়
- ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে অনেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না
- অজ্ঞতা ও অশিক্ষা এ ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা
- বিরতিহীনভাবে বিদ্যুতের সরবরাহ সম্ভব নাও হতে পারে
- এখনো সব জায়গায় ইন্টারনেট সুবিধা নেই
- স্থানীয় চিকিৎসক, বিশেষ করে গ্রাম্য ডাক্তাররা বিষয়টিকে সহজভাবে নাও নিতে পারেন
- রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমতো করা সম্ভব নাও হতে পারে।
তবে সাধারণ জনগণ যদি মনে করে বিষয়টি তাদের জন্য উপকারী কেবল তখনই যেকোনো ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব। তা ছাড়া জনসাধারণকে সচেতন করা গেলে এ ধরনের সীমাবদ্ধতা খুব একটা স্থায়িত্ব পাবে না।
টেলিমেডিসিন ও বাংলাদেশ টেলিমেডিসিন অ্যাসোসিয়েশন
টেলিমেডিসিন সেবা দেশের সব মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিলÑ
- বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন নেটওয়ার্ক তৈরিতে ভূমিকা রাখা
- ভার্চুয়াল মেডিক্যাল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা
- চিকিৎসা পেশাজীবীদের বিষয়টি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান প্রদান করা
- গ্লোবাল ফেডারেশন অব টেলিমেডিসিন অর্গানাইজেশনের আঞ্চলিক কার্যালয় ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করা
- সার্কের সহায়তায় সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিহেলথ প্রতিষ্ঠা করা।
কারা টেলিমেডিসিন সেবা দিচ্ছেন
- মেডিনোভা মেডিক্যাল সার্ভিসেস
- সিআরপি
- বারডেম, ফরিদপুর, ঢাকা
গ্রামীণফোন, বাংলালিক, জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল জাতীয় সেবার উদ্যোগ নিলেও তাদের বিষয়টি অনেকটা কলসেন্টারের মতো। এ উদ্যোগকে পুরোপুরি টেলিমেডিসিন সেবা বলা না গেলেও বিষয়টি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
এ ছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেক চিকিৎসক টেলিমেডিসিন সেবা দিচ্ছেন। তবে এ সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।
এম-হেলথ
ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার সর্বশেষ সংযোজন এম-হেলথ বা মোবাইল হেলথ। এ ক্ষেত্রে কেউ স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়লে নির্দিষ্ট একটি নম্বরে কল করতে হয়। যেমন, কেউ পানিতে পড়ে গেলÑ করণীয় সম্পর্কে এম-হেলথে ফোন করেন, তবে তাকে ছোট ছোট কিছু ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এসব ভিডিও ক্লিপ দেখে রোগীর আশেপাশের লোকজন দ্রুত চিকিৎসাসেবা নিজেই দিতে সক্ষম হন। আমাদের দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক এখন মোবাইল ফোন ব্যাবহার করছেন। ফলে খুব দ্রুত বিষয়টি প্রসার লাভ করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তিতে আমাদের দেশ এগিয়েছে অনেক দূর। সরকার তাই টেলিমেডিসিনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলে এ দেশ চিকিৎসাসেবায়ও বিশ্বমান অর্জন করবে অচিরেই।
m~Z&ª: দৈনিক কালেরকন্ঠ(15/01/2011)
No comments:
Post a Comment