Search This Blog

Monday, April 18, 2011

ডায়াবেটিসে ইনসুলিন

অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিম উদ্দীন


ডায়াবেটিসের কারণ হল ইনসুলিনস্বল্পতা৷ এই স্বল্পতা আংশিক হতে পারে, সম্পূর্ণও হতে পারে৷ সব ডায়াবেটিস রোগীরই ইনসুলিন লাগে৷ কারও বছর বয়সে, কারও ৭২ বছর বয়সে৷

ইনসুলিনের বিবর্তন
১৯২১ সালে বেনটিং বেস্টের ইনসুলিন আবিষ্কারের পর থেকে এর রাসায়নিক পরিবর্তন করা হচ্ছে৷ বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্য হল মানুষের শরীরে যে ইনসুলিন সৃষ্টি হয় তা হুবহু না হলেও যতদূর সম্ভব একই রকমের একইভাবে কাজ করে এমন ইনসুলিন তৈরি করা৷
প্রথমে ছিল গরু (বোভাইন) শূকরের (পিগ) ইনসুলিন৷ বিশুদ্ধ করে বানানো হল মনোকম্পনেট (পিউরিফাইড) ইনসুলিন৷ এরপর এল হিউম্যান ইনসুলিন৷ এখন এসেছে ইনসুলিন এনালগ৷

ইনসুলিনের প্রকার
কতক্ষণ শরীরে কার্যক্ষম থাকে তা বিবেচনা করে ইনসুলিনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে :
. র্যাপিড অ্যাকটিং : দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করে এবং ঘণ্টা কার্যক্ষম থাকে৷ বাজারে আসা নতুন ইনসুলিন হচ্ছে অ্যানালগ লিসপ্রো, গ্লুলেসিন ইনজেকশন, যা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ করে৷
.শর্ট অ্যাকটিং : খাওয়ার আগে (আধা ঘণ্টার মধ্যে) দিতে হয়, ঘণ্টা সময় সর্বাধিক কাজ করে; ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করে৷
. লং/ইন্টারমিডিয়েট অ্যাকটিং বা বেজাল ইনসুলিন : হিউম্যান ইনসুলিন দেয়ার ঘণ্টা পরে কাজ শুরু হয়, ঘণ্টা সর্বাধিক কাজ পাওয়া যায়; ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করে৷ এনালগগুলো ২৪ ঘণ্টা কাজ করে; গ্লারজিন, লেভেমির ধরনের ইনসুলিন৷

কাদের ইনসুলিন দিতেই হবে
গর্ভবতী মহিলা, অনেক বেশি সুগার, কিটোনুরিয়া, সার্জারি ডায়াবেটিসের ইমার্জেন্সি থাকলে ইনসুলিনের বিকল্প নেই৷
তবে দিনে - বার করে সুঁই নেয়া সুখকর নয়৷ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সুগার প্যানক্রিয়াসের জন্য টক্সিন বা বিষ৷ গ্লুকোটক্সিসিটি থেকে প্যানক্রিয়াসকে উদ্ধার করতে না পারলে পরবর্তী সময়ে ইনসুলিন ছাড়া চিকিত্‍সা চলে না৷ তাই শুরুতে ইনসুলিনই সবচেয়ে উপযোগী চিকিত্‍সা৷
আবার যাদের সেকেন্ডারি ফেইলুরে হয়েছে সেক্ষেত্রে রোগী যতই অনুরোধ করুক তাদের ইনসুলিনের বিকল্প নেই৷ রোগী ওষুধও নিল কিন্তু ডায়াবেটিস কন্ট্রোল হল না মাঝখান থেকে কিডনি নষ্ট হল ধরনের চিকিত্‍সা দেয়ার কোন অর্থ হয় না৷
যে চিকিত্‍সাই দেয়া হোক না কেন রোগীর কমপ্লায়েন্স বা নেয়ার সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে৷ ডায়াবেটিস প্রতিদিনের রোগ-চিকিত্‍সা সার্থক করতে হলে রোগীর সহযোগিতা ছাড়া হবে না৷

কখন ইনসুলিন দেবেন
আগে থেকে চিকিত্‍সা পাচ্ছে এমন রোগীর হিমোগ্লবিন এ১সি .% হলে তার ইনসুলিন লাগবে৷ হিমোগ্লবিন এ১সি .% হলে ইনসুলিন ছাড়া চলবেই না৷ নতুন ডায়াবেটিকসদের বেলায় অবশ্য এটা প্রযোজ্য নয়৷
সবকিছু বৈজ্ঞানিক যুক্তি শুনেও অনেক রোগী ইনসুলিন নিতে চায় না৷ ইনসুলিন প্রেসক্রিপশনে লিখে মেটফরমিন, পায়োগিটাজনে, ভিলডাগিপটিনের কম্বিনেশন দিয়ে সময় বেঁধে দিলে রোগীর বাস্তবতা উপলব্ধি করা অস্বাভাবিক নয়৷

অন্য ওষুধ থেকে কিভাবে ইনসুলিনে সুইচ ওভার করবেন
ইনসুলিনের সঙ্গে মেটফরমিন, পায়োগিটাজনে, ভিলডাগিপটিন দিলে এ্যাকশন ত্বরান্বিত (সিনারজিজম) হয়; সুতরাং এগুলোর সঙ্গে ইনসুলিন যোগ করতে হবে৷ সালফনিলুরিয়ার সঙ্গে ইনসুলিন যোগ করলে এ্যাকশন ত্বরান্বিত (সিনারজিজম) হয় না তাই ইনসুলিন দিলে সালফনিলুরিয়া বাদ দেয়া ভাল; তবে বাস্তবতা হোল একবারে না দিয়ে আস্তে আস্তে (ট্যাপার করে) সালফনিলুরিয়া বাদ দেয়া উচিত৷ অপারেশনের আগে, পরে মেটফরমিন, পায়োগিটাজনে বাদ দেয়া ভালো৷ যে রোগীর মেটফরমিনে ভালো কন্ট্রোল ছিল তার অন্য ওষুধে কন্ট্রোল হতে সময় লাগে৷

দেয়ার পদ্ধতি
কাচের সিরিঞ্জ এখন আর নেই৷ ডিজপোজেবল সিরিঞ্জই বেশির ভাগ ব্যবহার হয়৷ আজকাল নানা রঙে বিভিন্ন ধরনের পেন বা ডিভাইস পাওয়া যায়৷ খরচ বেশি হলেও এগুলোর সূচ ছোট বিধায় অনেকেই পছন্দ করেন৷ ৪০ ইউনিটের সিরিঞ্জ মানে এক রি(সিসি)তে ৪০ ইউনিট, ১০০ ইউনিটের সিরিঞ্জ মানে এক রি(সিসি)তে ১০০ ইউনিট ইনসুলিন থাকে৷ ১০০ ইউনিটের সিরিঞ্জ দিয়ে তাই ১০০ ইউনিটের ইনসুলিন নিতে হবে৷ ঐকিক কষে ৪০ সিরিঞ্জ দিয়ে ১০০ ইউনিটের ইনসুলিন নিলে হবে না৷ ইনসুলিনের জায়গা পরিষ্কার করে ইনজেকশন দিলেই হবে; সূচ পরিষ্কার করার দরকার নেই৷ একটা সূচ দিয়ে দিন ইনজেকশন দেয়া যায়, দিতে দিতে যখন ব্যথা বোঝা যাবে তখন সূচ বদলাতে হবে৷

প্রথমে কতটুকু/কী ইনসুলিন নেবেন
কোন রোগী কোনদিন ওষুধ/চিকিত্‍সা নেয়নি তার জন্য দিনে .-. ইউ/কেজি/দিনে এবং অন্য ওষুধে হচ্ছে না এমন রোগীকে . থেকে ইউ/কেজি দিয়ে শুরু করতে হবে৷ প্রয়োজন অনুযায়ী যোগ-বিয়োগ করে ডোজ এডজাস্ট করতে হবে৷ যে কোন ডোজের পুরো ইফেক্ট পেতে দিন সময় লাগে৷

কিভাবে ডোজ ঠিক করবেন
প্রথমে বেজাল ইনসুলিন দিয়ে শুরু করতে হবে৷ ডেইলি ডোজ ত্রিশের বেশি লাগলে শর্ট/র্যাপিড অ্যাক্টিং ইনসুলিন যোগ করতে হবে৷ প্রথমে রাতের ডোজ দিয়ে শুরু করা যেতে পারে৷ যখন বেলা দেয়া হয় তখন সকাল / অংশ বিকালে / অংশ দেয়া ভালো৷ মিক্স করলে / অংশ শর্ট অ্যাক্টিং / অংশ লং বা ইন্টারমিডিয়েট অ্যাক্টিং যোগ করা ভালো৷ সকাল বেলা নাস্তার আগের সুগার বেশি হলে ওই দিন রাতে গিয়ে ইনসুলিন বাড়াতে হবে৷ সন্ধ্যারাতের সুগার বাড়লে পরের দিন সকালের ইনসুলিন বাড়াতে হবে৷ যেমন রোববার নাস্তার আগের সুগার কমলে সকালের ইনসুলিন বাদ দিলে সারাদিনের সুগার বেড়ে যাবে তাই সোমবারের সকালের সুগারের জন্য রোববার রাতের ইনসুলিন কম/বেশি করতে হবে৷ সারাদিনে ১০ ইউনিটের কম লাগলে তার ইনসুলিন ছাড়াই চিকিত্‍সা হওয়া উচিত৷

কিভাবে/কতটুকু/কখন দেবেন
ভেইন/মাংসে দিলে এ্যাকশন থাকে কয়েক মিনিট; চামড়ার নিচে দিলে থাকে ঘণ্টা বা দিন৷ ইনসুলিন খাওয়ার -২২ মিনিট আগে দিতে হবে; বাস্তবে খাওয়া রেডি রেখে ইনসুলিন নেয়া উচিত; ইনসুলিন নেয়ার পর খাওয়া বানানো/ওজু বা গোসল করতে যাওয়া বোকামি৷ তবে ইনসুলিন অ্যানালগের বেলায় এটা ঠিক নয়৷ নতুনত্ব বাজারে আসা অ্যনালগ ইনসুলিন ইনজেকশন দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ করে৷ খাওয়ার আগে-পরে যখন-তখন দেয়া যায়৷

কোথায় দেবেন
মোটা চামড়ায় ইনজেকশন দিতে হবে; দুই আঙ্গুলের মধ্যে পুরা চামড়া ধরে সূচ খাড়াভাবে ধরে পুরাটা চামড়ার নিচে ঢুকিয়ে দিতে হবে৷ অনেকেই মাংসে ঢুকে যাবে ভেবে সূচ কাত করে দেন যেটা যৌক্তিক নয়৷ কাত করে দিলে চামড়ার নিচে নয়, চামড়ার মধ্যে যায়, কার্যকারিতা কমে৷ একই জায়গায় বারবার ইনজেকশন দিলে চামড়া মোটা, কালো হয়ে যায়, ইনসুলিন ঢুকে না, কাজ হয় না৷ পাছা, উরু, ঊধর্্ব বাহু পেটের চামড়া ইনসুলিন নেয়ার জন্য ভালো৷
ইনসুলিন সংরক্ষণ : একবার খুললে ইনসুলিনের ভায়াল বা ডিভইস একমাস বাইরে রাখা যায়, রেফ্রিজারেটরে রাখার দরকার নেই৷ বাজারে যে দোকানে ইনসুলিন পাওয়া যায় তাদের শুধু রেফ্রিজারেটর থাকলেই হবে না, ইনসুলিন কিভাবে আনা-নেয়া হয়েছে সেটাও লক্ষ্য রাখতে হয়৷ ইনসুলিন কোল্ড (টান্ড) চেইনে সরবরাহের ব্যবস্থা থাকা জরুরি অর্থাত্‍ যে কারখানায় বানানো হয়েছে সেখান থেকে যে দোকানে বিক্রি হবে সে পর্যন্ত রেফ্রিজারেটরে বাহিত হতে হবে৷ পৃথিবীর অনেক দেশেই ফ্রি ইনসুলিন পাওয়া যায়, যারা ব্যাগে করে সঙ্গে অথবা লাগেজে আনেন সেখানে কোল্ড চেইন মেইনটেইন হয় তাই কার্যকারিতা থাকে৷

লেখক : মেডিসিন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ

বারডেম৷

সুত্র: দৈনিক যুগান্তর (12/02/2011)

No comments:

Post a Comment