শুক্র, ৬ মে ২০১১, ২৩ বৈশাখ ১৪১৮
ডা: স্যারালিন মার্ক বলেন, এসব তথ্যের পুরো সদব্যবহার করতে হলে, নারীদেরকে নিজের স্বাস্থ্যর দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে। ডাক্তারদের সঙ্গে অংশীদারহতে হবে স্বাস্থ্যভাবনায়। পারিবারিক রোগ ইতিহাস সন্ধান করার কাজ, হেলথ ইসুগুলো সম্বন্ধে নিজেদের অবহিত করা, নিজেদের শরীরের দেখভালকরা-এসব বিষয় একা সমাধান করা যায়না, ডাক্তার ও রোগী দু’তরফের উদ্যোগ ও সহায়তা চাই একটি অংশীদারিত্ব। আমেরিকান হেলথ ও হিউম্যানপরিবেশ বিভাগে নারী স্বাস্থ্য বিষয়ক উর্ধূতন চিকিত্সা পরামর্শক মার্ক বলেন, কিসে শরীর মন ভালো লাগে, কখন শরীর ভালো লাগেনা, সবই জানাআপনাদের। নিজের শরীরকে বোঝা হল মূল কথা।
হূদরোগ: নারী ও পুরুষের দুই পক্ষের জন্যই বড় ঘাতক রোগ হলো হূদরোগ। ইদানীং পত্রিকা ভরে প্রকাশিত একটি শীর্ষ খবরে দেখা যায় বাংলাদেশেরহাসপাতালেও হূদরোগে আক্রান্ত মানুষ সবচেয়ে বেশি মারা যান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ বুলেটিন ২০১০ থেকে প্রাপ্ত তথ্য। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ২০২০সাল নাগাদ হূদরোগ দেশে মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দেখা দেবে। দেশের হাসপাতালগুলোতে ২২.৮ শতাংশ মৃত্যুর কারণ হূদরোগ। আমেরিকার সিডিসিররিপোর্ট অনুযায়ী মেয়েদের ক্ষেত্রে ২৯% মৃত্যুর পেছনে হলো হূদরোগ। হূদরোগে আক্রান্ত নারীদের জন্য মৃত্যুই সবচেয়ে বড় সমস্যা নয়। ন্যাশনাল ওমেন’সহেলথ্ নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক সিনিড পিয়ারসন বলেন, সত্যিকারের সমস্যা হলো অকাল মৃত্যু এবং পঙ্গুত্ব বরণ করা।
আমেরিকার মত দেশে ৬০ বছর বয়সকালে বেশ কয়েক জন নারী মারা যান, এত কম বয়সে মৃত্যু সেদেশে ভাবা যায়না, না? পিয়ারসন বলেন, “সেদেশেএমন মহিলাও আছেন যারা অনেক বছর ধরে হূদরোগে সত্যি ভূগছেন-প্রায়ই শ্বাসকষ্ট, দু’একটি সিডিঁ উপরে উঠতে কষ্ট, কারণ হূদরোগ হলে এরা চলতেফিরতে অসুবিধা বোধ করছেন।” হূদরোগে মহিলাদের চেয়ে পুরুষরা বেশি মৃত্যু বরণ করেন সত্যি, তবে মেয়েদের রোগ নির্ণয় হয় কম, এমনও হয় যখনএটি আবিষ্কার হয়, তখন তেমন করার কিছু থাকেনা। মেয়েদের ক্ষেত্রে উপসর্গ বেশ নিজস্ব। এদের ডাক্তাররা অনেক সময় ধরতে পারেন না বা ভুলে যান, এমনকি রোগী নিজেও। হূদরোগ মানেই বুক ব্যথা, আমরা প্রায় ভাবি এমন নাও হতে পারে। অনেকের হয়ত হয় চোয়ালে সামান্য ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা, বমিভাব বা বমি বা শ্বাসকষ্ট।
আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশন বলেন, হূদরোগের ঝুঁকিগুলো হলো-
০০ বয়স বেশি
০০পুরুষ (পুরুষ তরুণ বয়সে হূদরোগে আক্রান্ত হতে পারেন)
০০ বংশগতি (গোত্রসহ) যাদের পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে এদের ঝুঁকি বেশি।
০০ আফ্রিকান, আমেরিকান, মেক্সিকান আমেরিকানস্, ন্যাটিভ আমেরিকানস্, ন্যাটিভ হাওয়াইয়ান, এশিয়ান, আমেরিকানস্। এদের ঝুঁকি বেশি।
০০ ধূমপান
০০ উচ্চমান কোলেস্টেরল
০০ উচ্চরক্তচাপ
০০ শরীরচর্চা না করা
০০ স্থূলতা ও ভারি শরীর
ওয়েইক ফরেস্ট ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিন পাবলিক হেলথ্ সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক গ্রেগরি বার্ক বলেন, ‘মেয়েদের ক্ষেত্রে হূদরোগের বোঝা অনেকবেশি।’ আগেকার দিনের মানুষ স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করতো, হূদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি তখন তাদের ছিলো অনেক কম।”
বার্ক বলেন, “জীবন যাপনের ধারা বদলে, যেমন সুপরিমিত খাদ্য গ্রহণ করে ও ব্যায়াম করে হূদরোগের ঝুঁকি কমানো যায়।
স্তন ক্যান্সার: মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে সচরাচর ক্যান্সার হলো স্তন ক্যান্সার। মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে ফুসফুসের ক্যান্সারের পরই এর স্থান। বিশেষজ্ঞরাবলেন, স্তন ক্যান্সার সম্বন্ধে ভয়ভীতি অতিশয় হলে বিপদ, এতে স্ক্রিনিং এর জন্য নারীদের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, এমনকি স্তনঅপসারণের মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় নেওয়া হয়, প্রয়োজন না থাকলেও। আমেরিকান মেডিকেল ওম্যান’স এসোসিয়েশনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্টডা: ডায়ানে হেলেনজানস্ বলেন, “স্তন ক্যান্সারের জন্য রয়েছে অনেক রকমের চিকিত্সা।” “এটি মৃত্যুদন্ড নয়।” তিনি নারীদেরকে এ ব্যাপারে নিজেদেরআবেগকে সংযত করতে ও সঠিক রাখতে এবং ইস্যুগুলো সম্বন্ধে নিজেদের অবহিত করার পরামর্শ দিয়েছেন। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি স্তন ক্যান্সারেরঝুঁকিগুলোর একটি তালিকা দিয়েছিলেন, যেমন-
০০ বেশি বয়স
০০ জীন, প্রায় ৫-১০% স্তন ক্যান্সার নির্দিষ্ট কিছু জীবনের মিউটেশনের সঙ্গে সম্পর্কিত। (সচরাচর, দি বিআর.সি.এ১ ও বিআরসিএ২ জীন)
০০ রোগের ব্যক্তিগত ইতিহাস
০০ গোত্র; আফ্রিকান, আমেরিকান নারীদের তুলনায় শ্বেতবর্ন মহিলাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি একটু বেশি। তবে এরোগে মৃত্যুর সম্ভাবনা আফ্রিকান, আমেরিকানদের বেশি।
০০ আগে স্তন বায়োপসির অস্বাভাবিক ফলাফল
০০ আগে স্তনে রেডিয়েশন
০০ ঋতুস্রাব আগে আগে শুরু হওয়া (১২ বছরের আগে) বা ৬৫ বছরের পর ঋতু বন্ধ হওয়া)
০০ সন্তান না হওয়া, নি:সন্তান
০০ ওষুধ ব্যবহার যেমন ডাই-ইথিল স্টিলবেসট্রোল (ডিইস)
০০ বেশি মদ্যপান
০০ স্থূলতা
আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ডা: স্টিফেন এফ. সেনের পরামর্শ দেন, ওজন নিয়ন্ত্রণ করা, ব্যায়াম করা, ধূমপান করে থাকলে বর্জন করা, ঝুঁকি সম্বন্ধে ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা এবং স্তন ক্যান্সারের যথাযথ স্ক্রিনিং এবং ঝুঁকিগুলোকে নজরে রাখা, খেয়াল করা। সেনের এও বলেন, “আপনারমা’র স্তন ক্যান্সার হয়নি বলে নিজে এ রোগে ইম্যুন তা কেন? “সেসঙ্গে কিছু মহিলা যাদের এক বা একাধিক ঝুঁকি রয়েছে বলে কখনই স্তন ক্যান্সার হবেনাতাও নয়। তাই খেয়াল রাখতে হবে সবদিকে।
ওস্টিওপরোসিস:কুজো বুড়ি, পিঠব্যথা, ভঙ্গুর শরীর বয়স্ক মহিলাদের এমন দুর্ভোগ হবার পরই হয়ত ডাক্তার রোগ নির্ণয় করে বললেন, ‘ওস্টিওপরোসিস।’ এখন বলা হচ্ছে, নারীরা এমন সমস্যা এডাবার সাতটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে- এদেশে সমস্যা কতটুকু তা আমার জানা নেই, তবেআমেরিকার তথ্য হলো, প্রায় ৪৪ মিলিয়ন আমেরিকান ওস্টিওপরোসিসের ঝুঁকির মুখোমুখি এর মধ্যে ৬৮% হলেন মহিলা, রিপোর্ট ন্যাশনালওস্টিওপরোসিস ফাউন্ডেশনের। ওস্টিওপরোসিস বেশ প্রতিরোধযোগ্য, শৈশবে, তরুণবয়সে ও আগ্ যৌবনে মেয়েরা যেসব আচরণ শিখে, রোগ হওয়ার পথেএদের ভূমিকা বেশ তাত্পর্যপূর্ণ বটে। কারণ শরীরে হাড় গঠন বেশিরভাগ হয় ৩০ বছর পর্যন্ত। এরপর নতুন হাড় গঠন বন্ধ হয়ে যায় এবং তখন নজরপড়ে পুরোনো হাড় বজায় রাখার উপর। হাড় মজবুত রাখার জন্য, হাড়ের ভাঙ্গন রোধ করার প্রচেষ্টার জন্য বিশেষ কোন বয়স নাই। হাড়ের ক্ষয়মেরামতির জন্য শরীর কাজ করেই, কিন্তু এর জন্য রসদ সরবরাহ করতে হবে, যেমন পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম ও ভারোত্তলনের মত ব্যায়াম। ওস্টিওপরোসিসেরঝুঁকিগুলো হলো:-
০০ নারী
০০ বুড়োবয়স
০০ ছোট হালকা গড়ন শরীর
০০ গোত্র, শ্বেতবর্ণ ও এশিয়ান মহিলার বেশি ঝুঁকি
০০ পারিবারিক ইতিহাস
০০ যৌন হরমোন, ঋতুচক্রে অনিয়ম ও রজ:নিবৃত্তির জন্য ইস্ট্রোজেনহানির ঝুঁকি বাড়ায়
০০ ক্ষুধামান্দ্র্য
০০ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি কম খাদ্য
০০ ওষুধ, গ্লুকোকটিফয়েড ও এন্টিকনডালসেন্ট
০০ শুয়ে বসে থাকা জীবন
০০ ধূমপান
০০ মদ্যপান ইত্যাদি
বিষন্নতা:বিষন্নতা রোগের গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ হচ্ছে স্থায়ী অসুখী, অনুভূতি, স্বাভাবিক কাজ করার প্রতি অনাগ্রহ, অক্ষমতা, অনুভূতির উপর নিয়ন্ত্রণহীনতাইত্যাদি। আশাহত, অসাহয়ত্ব এবং পাপবোধে জড়িয়ে যাওয়া। যার সাথে তাদের বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই, সেই সব বিষয়ের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা, নিজের দোষ খোঁজা ইত্যাদি উপসর্গগুলোকেও অবহেলা করা যাবে না। এছাড়াও আরো কিছু উপসর্গ আছে যেমন:
০০ ঘুমের সমস্যা
০০ ওজন ও ক্ষুধার সমস্যা
০০ দৈহিক শক্তি কমে যাওয়া
০০ আনন্দময় জীবন যাপন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া
০০ মনোযোগের অভাব, ভুলে যাওয়া
০০ খারাপ চিন্তা করা
অটোইম্যুন রোগ: অটোইম্যুন রোগ হলো এমন ধরণের রোগ যেখানে দেহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শরীরকে আক্রমণ করে এবং টিস্যুকে ধ্বংস করে যা বদলে দেয়।এধরনের প্রায় আশিটি রোগ আছে, যেমন লুপস, মালটিপল, স্কেলরোসিস এবং টাইপ-১ ডায়াবেটিস।
আমেরিকান অটোইম্যুন রিলেটেড ডিজিজেস এসোসিয়েশনের মতে, ৭৫% অটোইমুন রোগ হয় মেয়েদের। হয়ত সবগুলো বিচার করলে, প্রতিটি রোগ হয়ততেমন সচরাচর নয়, অবশ্য ডায়াবেটিস, থাইরয়েড রোগ ও লুপাস ব্যতিক্রম। তবে দল হিসেবে আমেরিকান নারীদের মধ্যে এ রোগগুলো অসুখ ওঅক্ষমতার চতুর্থ প্রধান কারণ। তবে কেনই যে শরীর নিজের প্রতি নিজেই বৈরী হয়ে যায় তা তেমন জানা নেই, তবে জীনগত, হরমোনগত ও পরিবেশগতউপাদান এতে সংশ্লিষ্ট তা মনে করা যায়। এক্ষেত্রে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। যেহেতু অটোইম্যুন রোগ তেমন স্পষ্টভাবে বোঝা যায়নি, তাই নির্দিষ্ট ঝুঁকিচিহ্নিত করা মুসকিল। উপসর্গগুলো তেমন নির্দিষ্ট না হতে পারে, রোগ নির্ণয় হয় কঠিন। তবে প্রিয় জনের এমন সমস্যা হলে সঙ্গ দেওয়া প্রয়োজন হয়, চিকিত্সক দেখানোর জন্য প্রয়োজন হয় সাহায্যোর।
অধ্যাপক (ডা:) শুভাগত চৌধুরী, পরিচালক, ল্যাবরেটরী সার্ভিসেস, বারডেম, ঢাকা
No comments:
Post a Comment